হযরত ইদ্রীস আঃ এর জীবনী
হযরত ইদ্রীস (আলাইহিস সালাম) ছিলেন আল্লাহর একজন প্রিয় নবী, যিনি মানব ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেন। তিনি ইসলামের নবীদের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন নবী এবং পবিত্র কুরআনে তাঁর নাম উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর জীবন কাহিনি, অবদান, এবং আধ্যাত্মিক উচ্চতা সম্পর্কে জানতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ:
পরিচিতি
ও জন্ম:
Ø নাম: ইদ্রীস
(আঃ)।
Ø পিতা: ইয়ারিদ।
Ø উপাধি: আল-মুয়াল্লিম
(শিক্ষক)।
Ø বংশ: তিনি
হযরত আদম (আঃ)-এর সপ্তম প্রজন্ম।
Ø স্থান: তিনি
সম্ভবত মিসর বা ইরাক অঞ্চলে বসবাস করতেন।
নবুয়ত
প্রাপ্তি:
হযরত ইদ্রীস (আঃ)
নবুয়তের দায়িত্ব লাভ করেন এমন সময়ে, যখন মানুষ
আল্লাহর প্রতি অবাধ্য হতে শুরু করে। আল্লাহ তাঁকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন, যাতে
তিনি মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন।
উল্লেখযোগ্য
অবদান:
v
লেখালেখি
এবং জ্ঞান:
§ হযরত ইদ্রীস (আঃ)-কে মানব জাতির মধ্যে
প্রথম কলম দিয়ে লেখালেখির কৌশল শিক্ষা দেওয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
§ তিনি মানুষকে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, এবং
প্রযুক্তির প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিলেন।
v
সেলাই
ও পোশাক:
§ হযরত ইদ্রীস (আঃ) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি
সুই-সুতার সাহায্যে কাপড় তৈরি করেছিলেন। এর আগে মানুষ পশুর চামড়া ব্যবহার করত।
ইবাদত ও আধ্যাত্মিকতা:
·
তিনি
তাঁর জাতির মধ্যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ইবাদতের গুরুত্ব প্রচার করেন।
·
তিনি
দৈনিক আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্ধারিত সময় ভাগ করতেন এবং জাতিকে ধর্মীয় দায়িত্ব
পালনে উদ্বুদ্ধ করতেন।
কুরআনে
উল্লেখ:
কুরআনে তাঁর নাম
দু'বার এসেছে:
v
সূরা
মারিয়াম (৫৬-৫৭):
“এবং
কিতাবে ইদ্রীসের বর্ণনা করো। নিশ্চয়ই সে ছিল সত্যনিষ্ঠ ও একজন নবী। আর আমি তাকে
উত্তোলন করেছি এক উচ্চ মর্যাদায়।”
v
সূরা
আম্বিয়া (৮৫):
“আর স্মরণ করো ইদ্রীস, যিনি
ছিলেন ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত।”
কাদের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন:
হযরত ইদ্রীস
(আঃ)-এর জাতি ছিল আদম (আঃ)-এর বংশধর। এই মানুষদের মধ্যে এক সময় আল্লাহর প্রতি
অবাধ্যতা ও ভুল কাজ বৃদ্ধি পায়। তাঁরা আল্লাহর একত্ববাদ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে
এবং পাপাচারে লিপ্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ হযরত ইদ্রীস (আঃ)-কে পাঠান মানুষকে
সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য।
তাঁর
দায়িত্ব:
Ø
মানুষকে
আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করতে বলা।
Ø
পাপ
থেকে বিরত থাকার এবং ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দেওয়া।
Ø
ইবাদত
ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা।
হযরত ইদ্রীস (আঃ)
তাঁর জাতিকে আল্লাহর পথের দিকে ডাকতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং তাদের জীবনকে সৎ
ও ন্যায়পরায়ণ করার জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
সীমিত, কুরআনে উল্লেখিত তাঁর উচ্চ মর্যাদা থেকে বোঝা যায়, তিনি
তাঁর দায়িত্বে সফল ছিলেন।
উর্ধ্বে উত্তোলন:
হযরত ইদ্রীস
(আলাইহিস সালাম)-কে আসমানে উত্তোলনের ঘটনা কুরআনে সংক্ষেপে উল্লেখিত হয়েছে এবং
হাদীস ও ইসলামী ব্যাখ্যাকারদের সূত্রে এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা হযরত ইদ্রীস
(আঃ)-এর আধ্যাত্মিক উচ্চতা এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রতিফলন।
কুরআনে
উল্লেখ:
কুরআনে হযরত
ইদ্রীস (আঃ)-এর আসমানে উত্তোলনের বিষয়ে বলা হয়েছে:
"আর কিতাবে
ইদ্রীসের কথা স্মরণ করো। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ এবং একজন নবী। আর আমি তাকে উত্তোলন
করেছি এক উচ্চ মর্যাদায়।"
(সূরা মারিয়াম:
৫৬-৫৭)
এখানে "উচ্চ
মর্যাদা" বলতে তাঁর আসমানে উত্তোলন এবং সম্মানের ইঙ্গিত দেয়।
হাদীসের
আলোকে বিস্তারিত:
মিরাজের ঘটনা
বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উল্লেখ করেন,
"আমি মিরাজের রাতে
চতুর্থ আসমানে ইদ্রীস (আঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি।"
(সহীহ বুখারী ও
মুসলিম)
এ থেকে বোঝা যায়, ইদ্রীস
(আঃ)-কে আল্লাহ আসমানে উত্তোলন করেছিলেন, এবং
তিনি সেখানে সম্মানিত অবস্থানে রয়েছেন।
ইসলামী
ব্যাখ্যাকারদের বর্ণনা:
হাদীস ও
তাফসিরবিদদের মতে, হযরত ইদ্রীস
(আঃ)-এর আসমানে উত্তোলনের ঘটনার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
Ø
উর্ধ্বগমনের
কারণ:
ইদ্রীস (আঃ) অত্যন্ত ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ, এবং
আল্লাহর প্রতি নিবেদিত ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে আসমানে
উত্তোলন করেন।
Ø
একজন
ফেরেশতার সাহায্য:
একটি বর্ণনা অনুসারে, ইদ্রীস
(আঃ) মৃত্যুর আগে আসমানের অবস্থা দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এক ফেরেশতার মাধ্যমে
তাঁকে আকাশে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি চতুর্থ আসমানে পৌঁছেন।
সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নির্ধারিত হয়।
Ø
জান্নাতের
স্থান:
ব্যাখ্যাকারদের মতে, ইদ্রীস
(আঃ)-কে জান্নাতে এমন একটি স্থানে রাখা হয়েছে, যেখানে
তিনি আখিরাত পর্যন্ত শান্তিতে থাকবেন।
Ø তাঁর আসমানে উত্তোলন থেকে শিক্ষা:
Ø আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্যের
পুরস্কার পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে আসমানের উচ্চতায় পৌঁছায়।
Ø আধ্যাত্মিক জীবন এবং ধার্মিকতার
গুরুত্ব।
Ø আল্লাহর প্রিয় বান্দারা পৃথিবী ও
আখিরাতে সম্মানিত হন।
হযরত ইদ্রীস
(আঃ)-এর আসমানে উত্তোলন ইসলামী ইতিহাসের একটি মহান এবং অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা। এটি
আমাদের শেখায়, আল্লাহর প্রতি
সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে পরকালীন জীবনে অনন্য মর্যাদা লাভ করা যায়।
শিক্ষা
ও নৈতিকতা:
হযরত ইদ্রীস
(আঃ)-এর জীবন থেকে আমরা নিম্নলিখিত শিক্ষা পাই:
Ø আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও ইবাদত
করা। জ্ঞানচর্চা ও উদ্ভাবনকে জীবনের অংশ
করা।
Ø ন্যায়পরায়ণতা এবং ধৈর্যের মাধ্যমে
মানুষের কল্যাণে কাজ করা।
Ø আধ্যাত্মিকতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির
সমন্বয় ঘটানো।
উপসংহার:
হযরত ইদ্রীস
(আঃ)-এর জীবনী আমাদের শেখায় যে জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
তিনি ছিলেন একজন মহান শিক্ষক এবং সমাজ সংস্কারক, যিনি
মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর জীবনের মাধ্যমে আমাদের জন্য
দৃষ্টান্ত রেখেছেন, যা অনুসরণ করলে আমরা আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।